Blue Economy Of Bangladesh

বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতি



বিংশ শতাব্দীজুড়ে পরিবেশগত নানা আন্দোলন ও সম্মেলন আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে একের পর এক পরিবেশবান্ধব মডেল। এসব মডেলের মধ্যে গ্রিন ইকোনমি মডেল বা সবুজ অর্থনীতি মডেল ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল এই মডেলের অধিকতর সম্প্রসারণের। গ্রিন ইকোনমি মডেলের পরবর্তী ধাপ তথা সম্প্রসারণই ব্লু-ইকোনমি নামে পরিচিত, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে ইতোমধ্যেই পৃথিবীজুড়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে।
১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলিসর্বপ্রথম একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন।এ অর্থনীতিকে সমুদ্র অর্থনীতিও বলা হয়। তার উপাদানগুলো হচ্ছে- জাহাজবাহিত বা সমুদ্রবাহিত বাণিজ্য, সাগর তলদেশে বিদ্যমান তেল-গ্যাস, বন্দর, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, উপকূলীয় পর্যটন শিল্প, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ইত্যাদিস্বল্পোন্নত দেশের স্ট্যাটাস থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখার জন্য সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিকাশ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।


বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির অগ্রযাত্রা
বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে সমুদ্রে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ জড়িত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গোপসাগরের বহুমাত্রিক বিশাল সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করেই সমুদ্রে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যদ্যটেরিটোরিয়ালওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট-১৯৭৪আইনপ্রণয়নকরেএকদূরদৃষ্টিসম্পন্নরাষ্ট্রনায়কেরপরিচয়দেন।পরবর্তীতে, বর্তমান সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় গত ২০১৪-২০১৫ সময়কালে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত আদালতে দায়েরকৃত মামলার রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও খনিজসম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার পেয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পরপরই বাংলাদেশের সমান ভূখণ্ডেরও বেশি জায়গায় কী পরিমাণ মৎস্যসম্পদ, খনিজ সম্পদ, নৌ চলাচলসহ অন্যান্য কী ধরনের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে ১৯টি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করে বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সূচনা করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
1.সমুদ্র বাণিজ্য:
বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ২০ ভাগ জোগান আসে সমুদ্র থেকে। বিশ্বের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৬ ভাগের অবদান খোদ বঙ্গোপসাগরের। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ উৎপাদন আরো বহু গুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। কেবল সমুদ্র অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই যথেষ্ট আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধন করা যেতে পারে। পরিবেশ দূষণ রোধের বিষয়কে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ব্লুু-ইকোনমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার হ্রাস ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিকে গুরুত্বারোপ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৫৪ লাখ লোক সরাসরি এ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত, যাদের বার্ষিক মোট আয় প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ইউরো। সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশের বিনিয়োগ ব্যুরো ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের অনুসৃতকৌশল ও বিশেষজ্ঞগণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এখন বাংলাদেশ সরকারকেই তার ভূকৌশলগত সুবিধার ভিত্তিতে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
2.মৎস্য সম্পদ:
বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। প্রতি বছর সেখান থেকে ৬৬ লাখ টন মৎস্য আহরণ করা যেতে পারে; কিন্তু বাস্তবে আমরা সেখান থেকে খুব কমই আহরণ করছি। আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনে মৎস্য খাতের অবদান সাড়ে চার ভাগেরও কম। অথচ সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা তা অনেকাংশে বাড়িয়ে ফেলতে পারি। এ জন্য আমাদের আধুনিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মাছ ধরার কৌশলে ও পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।
3.খনিজ সম্পদ:
মৎস্য সম্পদ ছাড়া ও আমাদের সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বহু খনিজ সম্পদ। খনিজ সম্পদগুলোর মধ্যে লবণের কথা বললে আমাদের উপকূলে রয়েছে ৩০০ লবণ শোধনাগার যেগুলো বিগত সাত বছর যাবত বছরে ৩.৫ লাখ টন করে লবণ উৎপাদন করছে। যা বাজারের চাহিদার তুলনায় খুব একটা যথেষ্ট নয়। লবণ শিল্পের দিকে একটু মনোযোগ দিলেই লবণ শিল্পকে একটি রফতানিমুখী লাভজনক শিল্পে পরিণত করা সম্ভব।

4.পর্যটন:

বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে পর্যটন। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন থাকার ফলে বাংলাদেশেও এ শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে জিডিপির অবদান ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে পর্যটন খাত থেকে আয় হয়েছিল ৮০৭ কোটি ৩২ লাখ টাকাপৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন খাত। দেশের সমুদ্র তীরবর্তী অন্যান্য পর্যটন অঞ্চল হচ্ছে পতেঙ্গা, পারকী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কুয়াকাটা, কটকা। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে ২০ লাখ পর্যটক আসে যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।২০১৮ সাল নাগাদ দেশে পর্যটকের সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত করার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। এজন্য ভিজিট বাংলাদেশ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে।কক্সবাজারের সাবরাং অঞ্চলে শুধু বিদেশি পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে১০০ একর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হবে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন। এখানে থাকবে মোটেল, রিসোর্ট, গেমিং জোন, কনভেনশন সেন্টার, সিনেপ্লেক্স, ফুড কোর্ট, বিচ ট্যুর অপারেটর।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে পর্যটন শিল্পকে অন্যতম অর্থনৈতিক খাত হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে।


1.বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে যে সকল সম্পদ পেতে পারে তাহলো বিভিন্ন খনিজ পদার্থ যেমন—গ্যাস, তেল, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেলসহ অনেক মূল্যবান ধাতু যেমন—কোবাল্ট ইত্যাদি। তাছাড়া আমরা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা এবং ওষুধ শিল্পেও আরো উপকৃত হতে পারি। ব্লু-ইকোনমির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয় চালু ও সেখানে পর্যাপ্ত আসন সংখ্যার ব্যবস্থা করতে হবে। সামুদ্রিক সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক বিকাশ সাধনের জন্য আমাদের আগে সুনির্দিষ্ট খাতগুলো যেমন—অ্যাকুয়াকালচার, পর্যটন, মেরিন বায়োটেকনোলজি, শক্তি (তেল-গ্যাস), সমুদ্রতলে খনি-খনন ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে হবে।
2. সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের অবসানের পর আমরা বাংলাদেশের আয়তনের ৮০ শতাংশের মতো বিশাল সমুদ্র এলাকা লাভ করি, যা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য খুবই গৌরবের ও আনন্দের; কিন্তু এ সুবিশাল সম্পদকে যদি আমরা সঠিকভাবে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে আমাদের এ অর্জনের কোনো মূল্য থাকবে না।
3: সমুদ্রে মাছ আহরণের পরিমাণ বাড়াতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একনেকের অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের মধ্যে ‘টেকসই উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদফতর। মূলত উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে সামনে রেখে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তাছাড়া দারিদ্র্যবিমোচন এবং পরিবেশের ভারসাম্যও প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া প্রকল্পটির মাধ্যমে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা হবে। মৎস্য চাষ ও আহরণে নিয়োজিত জনশক্তির জীবনমান উন্নয়নেও গুরুত্ব দেওয়া হবে।
4. ২০ কোটি ডলারের মধ্যে সুশাসন ও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রকল্পটির আওতায় সাত কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করা হবে। এর মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো, সরকারি ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, ২০০৮ সালে প্রণীত মৎস্যনীতির সংস্কার এবং উপকূলীয় মৎস্য ব্যবস্থাপনায় মৎস্য অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় মৎস্য আহরণে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ও কাক্সিক্ষত পুষ্টি নিশ্চিত করতে ব্যয় করা হবে ৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। মাছ আহরণে নিয়োজিত জনশক্তির দক্ষতা বাড়ানো হবে। তাছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন ও উপকূলীয় জলবায়ু রক্ষায়ও অর্থ বরাদ্দ থাকবে। শৃঙ্খলা রক্ষায় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত জনশক্তিকে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে প্রকল্পের আওতায়। মাছ আহরণে নিয়ন্ত্রণ আনতে এসব পরিচয়পত্রের আলোকে দেওয়া হবে খাদ্য সহায়তা (সূত্র বিশ্বব্যাংক)।

টেকসই উন্নয়নের জন্য টেকসই ব্লু-ইকোনমি ও প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয় যদি না সমুদ্রাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সমুদ্রের পরিবেশ এবং জীব ও অজীব সম্পদের সংরক্ষণ এবং সমুদ্রকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানো যায়। জলদস্যুতা, মাদক, অস্ত্র, মানব পাচার ইত্যাদি আমাদের সমুদ্রাঞ্চলের খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়া উপকূলীয় শিল্প কলকারখানাগুলোর বর্জ্য নিঃসরণ, জাহাজ ভাঙা শিল্প ও বৈষয়িক জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি সাগরের স্বাভাবিক পরিবেশের জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি তৈরি করছে। এসব সমস্যাগুলোকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নিমিত্তে একটি কার্যকর কৌশল অবলম্বন করা বাংলাদেশ সরকারের জন্য সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।



Blue Economy Of Bangladesh Blue Economy Of Bangladesh Reviewed by studynotebd on April 29, 2018 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.